শরীফ মুহাম্মদ- একটি নাম, একটি জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। নানা গুণে গুণী সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ। বাংলাদেশের মিডিয়াঙ্গন আলোকিতকারী একজন আলেমে দীন। বাংলাদেশ নামক এক ছোট্ট দেশের সীমানা ছাপিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে কয়জন আলেম লেখক পরিচিতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ তাদের অন্যতম। শরীফ মুহাম্মদ নামটি ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি ছদ্মনামে লিখেন তিনি। তার ব্যবহৃত ছদ্ম নামগুলো হলো- আবু তাশরীফ, ওয়ারিশ রাব্বানী এবং খসরু খান।
জামিয়া ইসলামিয়া ময়মনসিংহের নুরানি বিভাগে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে শরীফ মুহাম্মদের পড়াশোনা জীবনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর তিনি এক বছর পড়াশোনা করেছেন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের সন্নিকটে অবস্থিত জামিয়া নুরিয়া বাগে জান্নাত মাদরাসায়। এরপর চলে এসেছেন ঢাকাতে এবং ভর্তি হয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আধ্যাত্মিক পুরুষ মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা জামিয়া নুরিয়াতে। ১৯৯২ সালে কওমি মাদরাসার একাডেমিক পড়াশোনার সর্বোচ্চ শিক্ষাস্তর দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেছেন জামিয়া কোরআনিয়া লালবাগ মাদরাসা থেকে।
আগাগোড়া কওমি মাদরাসায় পড়ুয়া একজন আলেম মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। কওমি মাদরাসা ছাড়া কোনো স্কুল-কলেজ বা আলিয়া মাদরাসায় কখনো পড়াশোনা করা এবং কোনো সরকারি ডিগ্রী-সার্টিফিকেট গ্রহণ করার সুযোগ হয়নি। পিতা আলহাজ গোলাম রব্বানী এবং মাতা ফেরদৌস বেগমের সন্তান শরীফ মুহাম্মদের জন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৭১ সালে, ময়মনসিংহে। তার স্থায়ী ঠিকানা, ১৯ জেল রোড, গলগন্ডা, ময়মনসিংহ। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন পল্লবী, মিরপুর, ঢাকায়।
কওমি পড়ুয়া আলেম হয়েও মিডিয়াতে এলেন কেন? এমন প্রশ্ন করা হলো শরীফ মুহাম্মদ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি জিনিসটা আমার রক্তে মিশে ছিলো। যখন যাই করতাম, সব সময় লেখালেখি করার একটা সুযোগ খুঁজে বেড়াতো আমার মন। ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে মাদরাসায় পড়ানোর পাশাপাশি প্রতিদিন বিকালে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রতিষ্ঠিত সপ্তাহিক মুসলিম জাহান পত্রিকাতে যাতায়াত করতাম এবং কিছু কাজও করতাম। এভাবেই আমার ভেতরকার লেখালেখি বিকশিত হতে শুরু করে এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশিত হলে সেখানে সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
খুব ছোটবেলায় শুধু লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিলো কিন্তু যখন কিছুটা সচেতন হলাম। বয়সের অংকের ঘরটি যখন ১৫-১৬-তে এসে পৌঁছালো, তখন আমার মাঝে লেখালেখির বিচিত্র ধরনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বেশ ভালোরকম ঝোঁক জন্ম নিয়েছিলো। আমি তখন মিডিয়াতে কাজ করার মূল রুপ ও পদ্ধতিটা বুঝতাম না কিন্তু নিজেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন (আমার নিজের প্রদান করা নাম) নামের দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে স্বপ্ন দেখতাম। ঠিক তখন থেকে এখন পর্যন্ত আলেম উলামাদের প্রভাবযুক্ত একটি দৈনিক পত্রিকার স্বপ্ন দেখেছি, দেখছি এবং ভবিষ্যতেও হয়তো দেখবো, ইনশা আল্লাহ।’
মাওলানা শরীফ মুহাম্মদকে প্রশ্ন করা হয়, আলেম হয়ে আপনি একটি দৈনিক পত্রিকার স্বপ্ন দেখেছেন এবং আরো অনেক আলেমরাই এমন স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু আলেমদের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত কোনো দৈনিক পত্রিকা বাজারে আসেনি। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এর মূলত কারণ আমার কাছে দুটি। এক. দৈনিক পত্রিকা করাটা অনেক বড় অংকের বিনিয়োগ সাপেক্ষ একটি বিষয়। দুই. আমরা আলেম-উলামারা এখনও মিডিয়া থাকা এবং মিডিয়া না থাকার প্রকৃত গুরুত্বটা অনুভব করতে সক্ষম হইনি।’
মাদরাসা থেকে প্রকাশিত দেয়ালিকায় লিখতেন ছোট্ট বালক শরীফ। ধীরে ধীরে দেয়ালিকার জমিন পেরিয়ে লেখা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে পত্রিকার কাগজে। ১৯৮৭ বা ৮৮ সালে সাপ্তাহিক জাগো প্রহরীতে সময়ের কান্না নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় তার। এরপর আর থেমে থাকা নয়, অন্তরজগতে পুষে রাখা সুপ্ত বাসনার পাখায় ভর করে লিখে চলেছেন সংবাদপত্র জগতের গোটা আকাশময়। সাহাবায়ে কেরামের গল্প- শরীফ মুহাম্মদ রচিত প্রথম বই, প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৬ সালে। তার রচিত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২০টি। ‘সবুজ গম্বুজের ছায়া’, ‘ইতিহাসের লাল আস্তিন’, ‘জীবনের নানা রঙ’, ‘শুধু তোমাদের জন্য’, ‘সকালের মিষ্টি রোদ’, ‘পত্রিকায় লেখালেখি : প্রস্তুতি ও কলাকৌশল’, ‘জীবন এখন যেমন’, ‘সুপ্রভাত মাদরাসা’, ‘ছদ্মবেশী প্রগতিশীল’, ‘সাদা সভ্যতার কালো মুখ’, ‘ক্ষয় ও জয়ের গল্প’, ‘ইসলাম জীবনের ধর্ম’ এবং ‘গণমাধ্যমের বিচিত্র ভ্রষ্টতার নাম’ তার রচিত গ্রন্থের মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। এছাড়াও তিনি মাসিক আল কাউসারের নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক যমযমের সম্পাদক ও সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান, মাসিক আল জামেয়া ও বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটনেটের সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেছেন। সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু মূল্যবান স্মারকগ্রন্থও। এর মধ্যে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) স্মারকগ্রন্থ, মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.) স্মারকগ্রন্থ এবং আল্লামা গহরপুরী (রহ.) স্মারকগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
লেখালেখির বাহিরে সম্প্রতি মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ইসলাম ও চলমান বিভিন্ন সমসাময়িক ইস্যুভিত্তিক টক শোগুলোতে কথা বলে বোদ্ধা মহলে বেশ সুনাম অর্জন করছেন। বর্তমান সময়ের চাহিদা ও দর্শক মনের খোরাক জোগাতে তার সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে ভিভিও বার্তাগুলোও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যাণ্ড দাওয়াহর পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত মাওলানা শরীফ মুহাম্মদের কাছে ইসলামের প্রচারে মিডিয়ার গুরুত্ব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘দাওয়াতের ধর্ম ইসলাম। ইসলাম ধর্মের মূলভিত্তিতে দাওয়াহর বিষয়টি জড়িত। আর দাওয়াহ পরিচালনায় মিডিয়ার বিকল্প নেই। সুতরাং মিডিয়ার সঙ্গে ইসলামের ইতিবাচক সম্পর্ক বিদ্যমান। এছাড়া ইসলামের ওপর ধেয়ে আসা বিভিন্ন প্রকার ও পদ্ধতির নেতিবাচকতার প্রতিরোধেও মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।’
২০০৯ সালে শিকড় সাহিত্য পুরষ্কার এবং ২০১২ সালে মাসিক আদর্শ নারীপদকপ্রাপ্ত এই গুণী মানুষটির কাছে জানতে চাওয়া হলো- করতে চেয়েছিলেন কিন্তু করা হয়ে উঠেনি এমন কোনো বিষয় আপনার জীবনে আছে কী না? উত্তরে তিনি বলেন, ‘নিজস্ব স্টাইলে হক্কানি আলেমদের প্রভাবযুক্ত একটি দৈনিক পত্রিকা করার স্বপ্ন দেখেছি আমি কিন্তু এখনও আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে কী না ঠিক জানি না।’